সুস্থতায় ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড
By SHAILA PARVIN
7 months ago
617

ফ্যাটি এসিড আমাদের শরীরের প্রয়োজনীয় উপাদান। মস্তিষ্কের শতকরা ৬০ ভাগই ফ্যাটি বস্তু। সেলমেমব্রেন, হরমোন, সিগনাল ম্যাসেঞ্জার প্রভৃতি তৈরিতে ফ্যাটি এসিড ভূমিকা রাখে। এটি দুই প্রকার : এসেনসিয়াল ও নন-এসেনসিয়াল ফ্যাটি এসিড।
এসেনসিয়াল ফ্যাটি এসিড আমাদের শরীর তৈরি করতে পারে না এবং খাবারের মাধ্যমে পেয়ে থাকি। নন-এসেনসিয়াল ফ্যাটি এসিড বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে শরীর প্রস্তুত করে থাকে। ফ্যাটি এসিডের বেশি প্রয়োজনীয় হল ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিড। গবেষণায় দেখা যায় ১৮০০ শতাব্দীর চেয়ে ২১০০ শতাব্দীতে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড খাওয়া প্রায় ছয় ভাগের ১ ভাগে নেমে এসেছে। অন্য গবেষণায় দেখা যায়, বর্তমানে আমাদের প্রয়োজনের এক দশমাংশ ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড খাচ্ছি এবং শতকরা ২০ ভাগ লোকের ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড গ্রহণমাত্রা আশংকাজনকভাবে কমে গেছে।
ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায় বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ (স্যামন, হ্যালিবাট, টুনা, সারডিন্যাস, মাকেরেল, হেরিং), ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ ডিম ও বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি। ইলিশ, রূপচাঁদা ও পাঙ্গাশ মাছে অল্প পরিমাণ ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায়। ওমেগা-৬ খাবারের মধ্যে আছে তিল, তিশি, বাদাম, মিষ্টিকুমড়া, দুগ্ধজাত পণ্য, শস্যজাতীয় খাদ্য, সূর্যমুখীর তেল প্রভৃতি। আমাদের খাদ্য তালিকায় যে পরিমাণ এবং যে প্রজাতির মাছ থাকে তা থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায় না।
উপকারিতা-
হাইপারট্রাইগ্লাইসেরাইডেমিয়া :
হাইপারট্রাইগ্লাইসেরাইডেমিয়ার (উচ্চমাত্রার টিজি) রোগীর ওপর ১৬ সপ্তাহ ধরে পরিচালিত এক গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় প্রতিদিন ৪ গ্রাম করে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড সেবনকারীদের ট্রাইগ্লাইসেরাইড বেসলাইন থেকে শতকরা ৪৪.৯ ভাগ কমে গিয়েছিল। এ রোগীদের সবারই এইচডিএলের (ভালো কলস্টেরল) পরিমাণ প্রায় ৯ শতাংশ বেড়ে ছিল। ২৫৪ জন রোগীর ওপর পরিচালিত অন্য গবেষণায় ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের সঙ্গে স্ট্যাটিন গ্রুপের ড্রাগ এবং শুধু স্ট্যাটিন গ্রুপের ড্রাগের ব্যবহার করা হয়েছিল। ৮ সপ্তাহ পরে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের সঙ্গে স্ট্যাটিন গ্রুপের ড্রাগ ব্যবহারকারীদের ট্রাইগ্লাইসেরাইড শতকরা ৪৩.৬ ভাগ কমে গিয়েছিল।
অস্বাভাবিক হৃদকম্পন :
করোনারি আর্টারি বাইপাস সার্জারির কিছু রোগীর ওপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায় ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড দৈনিক ২ গ্রাম ডোজে গ্রহণ করলে শতকরা ৫৪ ভাগ রোগীর অস্বাভাবিক হৃদকম্পন কমে গিয়েছিল।
করোনারি আর্টারি ডিজিজ :
এক স্টাডির ফলাফলে দেখা যায় দৈনিক ১ গ্রাম করে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড খেলে হঠাৎ করে হৃদরোগে মৃত্যুঝুঁকি শতকরা ৫৪ ভাগ হ্রাস পায়।
স্তন ক্যান্সার :
৩৫ হাজার মধ্যবয়সী মহিলার ওপর পরিচালিত গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় যারা নিয়মিত ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড সেবন করেন তাদের স্তন ক্যান্সারের হার শতকরা ৩২ ভাগ কমে যায়।
ডিপ ভেইন থ্রোম্বোসিস :
১৫ হাজার রোগীর ওপর ১২ বছর ধরে পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায় যারা সপ্তাহে অন্তত ১ গ্রাম ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড খান তাদের ডিপ ভেইন থ্রোম্বোসিসের ঝুঁকি শতকরা ৩০-৪৫ ভাগ কমে যায়।
হার্ট অ্যাটাক : জাপানে ৮০-৬০ বছরের ৪১ হাজার ৪৭৮ জন পুরুষের ওপর ১৯৯০ থেকে ২০০১ পর্যন্ত পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায় যারা সপ্তাহে অন্তত ১ গ্রাম ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড খান তাদের হার্ট অ্যাটাকের হার শতকরা ৫৬ ভাগ কমে যায়। ডোজ বাড়িয়ে দৈনিক ২ গ্রাম করলে হার্ট অ্যাটাকের হার শতকরা ৬৫ ভাগ কমে যায়।
স্ট্রোক :
যারা সপ্তাহে নিয়মিত ৫ গ্রাম ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড খান তাদের ইসকেমিক স্ট্রোকের ঝুঁকি শতকরা ৩১ ভাগ কমে যায়।
অ্যাথেরোস্কে¬রোসিস ইন পোস্ট মেনোপোজাল উইমেন : আমেরিকান জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল নিউট্রেশনে প্রকাশিত স্টাডি থেকে জানা যায় ডায়াবেটিস আছে এমন পোস্ট মেনোপোজাল উইমেনরা সপ্তাহে অন্তত ২ গ্রাম ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড খেলে তাদের অ্যাথেরোস্কে¬রোসিস হওয়ার আশংকা হ্রাস পায়।
ওজন হ্রাস ও ইনসুলিন সেনসিটিভিটি বাড়ানো : ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড লেপটিন নামক হরমোন নিঃসরণের মাধ্যমে আমাদের ক্ষুধা ও ওজন নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড সেবনে ইনসুলিন সেনসিটিভিটি বাড়ে ফলে অল্প ডোজে ইনসুলিন বেশি কাজ করে।
আর্থ্রাইটিস :
৫০০ জন রোগীর ওপর ১৩টি গবেষণায় দেখা যায়, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড আশাপ্রদ ফলাফল দেয়।
পিরিয়ডের পেইন :
৪২ জন মহিলার ওপর পরিচালিত গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় যেসব মহিলা প্লাসেবো খেয়েছিল তাদের তুলনায় যারা ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড খেয়েছিল তাদের পিরিয়ডের পেইন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছিল।
চোখের ছানি পড়া :
আরকাইভস অব অফথেলমোলজিতে প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে জানা যায়, ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড সেবনে বয়সের কারণে বা নির্দিষ্ট বয়সের আগেই চোখে ছানি পড়ার হার কমিয়ে দেয়। আরকাইভস থেকে আরও জানা যায় ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড খেলে বয়সজনিত ছানিপড়া শতকরা ৭৫ ভাগ কমে যায়।
মনোযোগহীনতা :
১০০ বালকের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, যাদের শরীরে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের পরিমাণ কম তাদের পড়াশোনায়ও মনোযোগ কম; এরা খুব সহজেই ভুলে যায়। ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের পরিমাণ বেশি থাকলে তাদের কাজ-পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ তীক্ষè এবং স্মরণশক্তিও বেশি হয়।
রোদের ক্ষতিকারক রশ্মি থেকে ত্বক রক্ষা :
জার্নাল অব ইনভেস্টিগেশন ডার্মাটোলজি থেকে জানা যায় ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড ইপিডার্মাল ও ডার্মাল স্কিন সেলকে সূর্যের ক্ষতিকারক অতি বেগুনি রশ্মি থেকে রক্ষা করে।
মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি :
আমাদের মস্তিষ্কের শতকরা ৬০ ভাগ ফ্যাটি বস্তু। মস্তিষ্কের কোষের কাজের জন্য ইপিএ (ইকোছাপেনটানোইক এসিড) বিশেষভাবে প্রয়োজন। ওমেগা-৩ মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
কিশোর বয়সে উগ্রতা কমানো :
ইউরোপিয়ান জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল নিউট্রেশনের এক স্টাডিতে দেখা যায়, যেসব কিশোর নিয়মিত ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড খায় তাদের উগ্রতার (হসটিলিটি) হার যারা ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড খায় না তাদের চেয়ে শতকরা ১০ ভাগ কম। এ গবেষণায় ৩ হাজার ৫৮১ জন কিশোর-কিশোরীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
স্মৃতিভ্রম :
আরকাইভস অব নিউরোলজিতে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে দেখা যায় যাদের শরীরে উচ্চ মাত্রায় ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড আছে তাদের স্মৃতিভ্রম হওয়ার আশংকা যাদের শরীরে নিুমাত্রার ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড আছে তাদের চেয়ে শতকরা ৪৭ ভাগ কম।
প্রোস্টেট-কোলোরেকটাল ক্যান্সার :
সুইডেনের ক্যারোলিনা ইন্সটিটিউট অব স্টকহোম কর্তৃক প্রকাশিত জার্নাল থেকে জানা যায় সপ্তাহে ১-২ গ্রাম ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড খেলে প্রোস্টেট ক্যান্সার হওয়ার আশংকা শতকরা ৪৩ ভাগ কমে যায়। আমেরিকান জার্নাল অব ইপিডেমিওলোজি থেকে জানা যায়, যারা নিয়মিত ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড সেবন করেন তাদের কোলোরেকটার ক্যান্সার হওয়ার আশংকা যারা সেবন করেন না তাদের থেকে শতকরা ৪১ ভাগ কম। এ গবেষণা ১ হাজার ৪৫৫ জনের ওপর পরিচালিত এবং সেবন মাত্রা ছিল সপ্তাহে ৩-৫ গ্রাম।
শিশুর অ্যাজমা :
ইন্টারন্যাশনাল স্টাডি অন অ্যালার্জি অ্যান্ড অ্যাজমা ইন চাইল্ডহুড কর্তৃক প্রকাশিত তথ্যে জানা যায় ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড বাচ্চা বয়সে অ্যাজমার ঝুঁকি শতকরা ৫০ ভাগ কমায়।
ওমেগা-৩ পাওয়া যায় :
সামুদ্রিক মাছ, সীবাকথ্রন , ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ ডিম (ও-৩ ডিম) বা ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড (ও-৩ ক্যাপসুল) খাওয়ার মাধ্যমে ওমেগা-৩ পাওয়া যেতে পারে।