সততার দর্পণে শিক্ষাব্যবস্থা ও সমাজ
By Md. Liakat Ali
1 year ago
1152

মো. লিয়াকত আলীঃ
দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা বেশ আধুনিক ও উন্নত।তবে তা যুগোপযোগী ও মূল্যবোধ সমাজ গঠনে কতটা অনুঘটক তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। চলমান শিক্ষাব্যবস্থা এপর্যন্ত যতজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি ও বুদ্ধিজীবী তৈরি করেছে, তার সিকি ভাগও সৎ ও দেশপ্রেমিক লোকের সৃষ্টি করতে পারেনি।
আবার প্রতিনিয়ত ওয়াজ,মাহফিল, মসজিদে হুজুররা ওয়াজ করেন, দেশের আইন না মানা মানে দেশের সাথে ওয়াদা ভঙ্গের শামিল। তার মানে রাষ্ট্রের আইন অমান্য করা কোন দেশ প্রেমিক বা ঈমানদার এর কাজ হতে পারে না। অথচ হরহামেশাই তৃণমূল থেকে শুরু করে জনসাধারণ, রাজনীতিক, পেশাজীবি, সরকারি কর্মকর্তা কিংবা সাংসদরা দেশের সাথে ওয়াদা ভঙ্গ করছে। ফলে আমরা কতটুকু দেশপ্রেমিক বা ঈমানদার তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আমরা কদমে কদমে ওয়াদা ভঙ্গ করছি।
এই দেশে যারাই দুর্নীতি করে, তারা কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সব থেকে মেধাবী শিক্ষার্থী। কারণ মেধাবী শিক্ষার্থী ছাড়া ভালো চাকরী করা সম্ভব নয়। যারা আমার মতো নিম্নতর স্থরের শিক্ষার্থী, তারা বড় কোনো চাকরী পায় না। সাধারণত বড় চাকরি বেশিরভাগ পায় মেধাবীরা। এ দেশের কৃষকেরা দুর্নীতি করে না। কুলিকামার কিংবা কেটে খাওয়া মানুষ দুর্নীতি করে না। এরা দুর্নীতির শিকার হয়। দুর্নীতির কারণে এদের স্বপ্নভঙ্গ হয়। তবু তারা জমির খাজনা দিয়ে দেশে শিক্ষিত সমাজ সৃষ্টি করে একটি সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যাশায়।
সাধারণত দেশের সবচেয়ে বেশি মেধাবীরাই ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার হয়। তার পরের স্থরের মেধাবীরা হয় সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা কিংবা অন্য কোন পেশাজীবি। আবার কেউ হয় বুদ্ধিজীবী বা সমাজ সংস্কারক। তাদের দিয়েই কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে। তবুও দেশের সর্বত্র অনিয়ম আর অনিয়ম। দুর্নীতি জ্যামিতিক হারে বেড়েই চলছে। তার কারণ কি? তাহলে কি ধরেই নিবো যতবড় মেধাবী, ততবড়……? আগে যেখানে মেধাবী জ্ঞানী লোকজন রাজনীতিক ছিলো, আজকে মেধাবী নেশাখোর লোকজন রাজনীতির আকাশে ডানা মেলছে।
তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যাটা হলো আমাদের তথাকথিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খুব কমই নৈতিকতা ও দেশ প্রেমের শিক্ষা দেওয়া হয়। আমরা আমাদের সামান্য শিক্ষাজীবনে খুব কম শিক্ষক( ২/৪ জন) পেয়েছি যারা আমাদেরকে দেশপ্রেম, মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার শিক্ষা দিয়েছেন। স্যারেরা ক্লাসে এসে নির্দিষ্ট টপিকের উপর আলোচনা করেই দায়িত্ব শেষ করেন। সততা, দেশপ্রেম ও নৈতিক জ্ঞানের আলো বিতরণ করা যেন তাদের কাছে নিষ্প্রয়োজন ।
আমার সামান্য পেশাগত জীবনে বিভিন্ন পেশায়জড়িত বেশ কয়জন ব্যক্তির সঙ্গ পেয়েছি যাদের অনেকেই সৎ, নীতিবাদী এবং খুব দেশ প্রেমিক। কিন্তু সমাজের বৃহদাকার নারকীয় কীট অসৎ ব্যক্তিদের থাবায় তারা কোনঠাসা। যেকারণে দেশের মানুষের চোখে এসব সৎ এবং ন্যায়পরায়ণ মানুষেরা আড়ালে থেকে যায়। এই অসৎ মানবের কারনে জনসাধারণ সৎ সরকারি চাকুরীজীবী মানুষ দেখে না। আমরা একজন ম্যাজিস্ট্রেট এর নাম জানি যিনি একটা এয়ারপোর্ট এর চিত্রটাই পালটে দিয়েছেন নিজের সততার বলে (যতটা সম্ভব)।
মাঝে মাঝে পত্রিকায় পড়ি, ওসি কিংবা এসপি বা টিএনও'র সততায় অমুক এলাকা অপরাধ মুক্ত। তখন আনন্দে মনটা ভরে উঠে। অন্যদিকে দূর্নীতির কারণে ট্রেন যোগাযোগ লাভজনক হওয়া সত্ত্বেও প্রতি বছর ভর্তুকি দেখানো হচ্ছে।
আমরা স্বভাবতই প্রত্যেকই নিজেকে দেশপ্রেমিক ও নীতিবান দাবি করি। তবে আমার ক্ষেত্রে বলা যায়, আমার মধ্যে যতটুকুই( হতে পারে খুবই সামান্য) সততা, আদর্শ বা মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা রয়েছে, তার বেশিরভাগই আমি আমার পরিবার থেকে শিখেছি। আমি দেখেছি আমার বাবা মা আমাকে আদর্শিক ও মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে কত চেষ্টায় না করেছেন। আজকে আমি যতটুকু অসৎ বা আত্নকেন্দ্রীক, তা আমি রাষ্ট্রের পরিবেশ থেকে শিখেছি। আমরা দেখে আসছি, এই দেশে অতি জঘন্য অনিয়ম করার পরেও সবাই তাকেই সম্মান করে। আজকে যাদের টাকা ও ক্ষমতা আছে তারাই সমাজের কাছে সম্মানিত এবং যেকোনো অনুষ্ঠানে অতিথির আসন অলংকৃত করছে। তারা দিনের আলোয় সমাজসেবক আর রাতের আঁধারে ভোগবাদী।
তাহলে আজকে তরুণ প্রজন্মের যারাই চাকরিতে আসে তারা সৎ থাকবে কেন? সৎ থাকার কোনো পরিবেশ কি রাষ্ট্র তাদেরকে দিয়েছে? শুধু সৎ থাকার কারণে তারা তাদের সন্তানকে কোনোদিন ভাল কাপড় দিতে পারবে না কিংবা ভাল স্কুলে পড়াতে পারবে না। অথচ সরকারি অফিসের একজন পিয়ন্ও তার ছেলেকে বাজারের সব থেকে ভালো জামা কিনে দিবে, শহরের নামি স্কুলে পড়াবে এবং একটা বড়সড় বাড়ি থাকবে। একজন সৎ ও দেশপ্রেমিক অফিসার ঠিকমত ডাল ভাত খেতে পারবে না। অথচ তার সামনেই এমএলএসএস বাজারের সব থেকে বড় মাছটা কিনে নিবে। সমাজের প্রতিটি স্তরে এমন শিক্ষিত ধান্দাবাজ, অসৎ, সুবিধাবাদী,মুনাফাখোর, পদ-ক্ষমতালোভী, আকাব্বর, মীরজাফর বিরাজ করছে। তাদের তোপে সততা আজ ভূলুণ্ঠিত।
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা সৎ, নৈতিক ও দেশপ্রেমিক মনন উৎপাদনে অক্ষম। শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও মনুষ্য লেবাসে অমানুষগুলো সততার পতাকা খামচে ধরছে। কেউ আল্লাহওয়ালা অভিনয় করছে ইহজগতে নিজের আখের গোছাতে, আবার কেউ একই কাজ করছে মহান প্রভুর সান্নিধ্যের জন্য। এ সমাজে যে যতটুকু অসৎ তার জন্য রাষ্ট্র এবং শিক্ষাব্যবস্থা দায়ী। যেই যতটুকু দুর্নীতিবাজ তার জন্য এই সমাজ ব্যবস্থা দায়ী। আর যে যতটুই সৎ তার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব কেবল তার ও পরিবারের। কৃতিত্ব আরেকজন সৎ লোকের কিংবা সৎ সঙ্গের।
এ সমাজে সততা, নৈতিকতা,দেশপ্রেমিক,পরহেজগার ও বুজুর্গী মানুষের সংখ্যা আকাশচুম্বী হলেও ক'জন সৎ মানব পাওয়া যাবে,যার চোখের সামনে কোটি কোটি কালো টাকা উড়তে দেখেও চোখ অন্যদিকে সরিয়ে নেবে কিংবা নির্জনে কোন অসহায় বোনকে রক্ষা করে নিরাপদে স্বস্থানে পৌঁছে দিবে!!